
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কবি মো. সেলিম হাসান দুর্জয়-এর দুই খণ্ডের কাব্যগ্রন্থ ‘দেবীসমগ্র (১)’ ও ‘দেবীসমগ্র (২)’। প্রেম, বিরহ, আত্মশুদ্ধি ও পুনর্জন্মের মিশেলে নির্মিত এই দ্বিখণ্ড কাব্য ইতোমধ্যে পাঠকমহলে সাড়া ফেলেছে। কবির ভাষায়, এটি নিছক প্রেমের কাব্য নয়—এ এক “প্রেম, পতন ও পুনর্জন্মের মহাকাব্যিক মানচিত্র”। তাঁর কাব্যভুবন, দর্শন ও সৃষ্টির অনুপ্রেরণা নিয়ে কথা বলেছেন তানজিদ শুভ্র’র সঙ্গে।
প্রশ্ন: ‘দেবীসমগ্র’ রচনার মূল অনুপ্রেরণা কোথা থেকে এলো?
দুর্জয়: জীবনের কোনো এক সময়ে- এক আলোকরশ্মি যা তীব্র সুগন্ধি আর ঝলমলে পবিত্র- আমাকে আহ্বান করে তার জীবনে; তারপর হঠাৎ অন্ধকার, তীব্র অসহ্য নির্লিপ্ততা; আমি এক অপরিচিত অথচ শান্ত গহ্বরে তলিয়ে যেতে থাকি। বাঁচার উপায় হিসেবে লিখতে শুরু করি দেবীসমগ্র।
প্রশ্ন: উত্তরটা কেমন ডিপ্লোমেটিক হয়ে গেল না?
দুর্জয়: হয়তো। হাহাহা... হয়তো না।
প্রশ্ন: দেবী চরিত্রকে আপনি কখনো প্রেমিকা, কখনো পূজিতা, আবার কখনো দ্রোহিণী হিসেবে দেখিয়েছেন—এই বহুরূপী দেবীর প্রতীকায়ন কীভাবে গড়ে উঠল?
দুর্জয়: দেবীসমগ্র এক নারীর শরীরী ও অশরীরী পবিত্রতা, আকর্ষণ ও অনুভবের দোলাচালের কাব্যকথা। নারীর শরীরী অনুভব পুরুষকে প্রেমিক করে তোলে, আর প্রেমিক সত্তা পুরুষ সত্তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রেমিকের চোখে তার নারী হয়ে ওঠে এক দিব্য দেবী। তবে নারী প্রকৃতির মতো বহমান যার অভিযোজন ক্ষমতা প্রবল। সময় আর চাহিদার প্রয়োজনে সে খুব দ্রুত নিজেকে অভিযোজিত করতে পারে। আমার তেমনটাই মনে হয়। বৈপরীত্য থাকতেই পারে।
প্রশ্ন: ‘দেবীসমগ্র’-এ গীতিনাট্যধর্মী কাঠামো বেছে নেওয়ার কারণ?
দুর্জয়: শুধু শব্দ বা ছন্দে দেবীর সৌকর্য প্রকাশে তৃপ্ত হতে পারিনি। তাঁর অভিরূপা দীপ্তিকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি মঞ্চ, চরিত্র ও অভিনয়ের আবহে। তাই গীতিনাট্যের কাঠামো বেছে নিয়েছি। তবুও আমি সত্যি বলতে পরিপূর্ণ তৃপ্ত হতে পারিনি।
প্রশ্ন: প্রথম খণ্ডে প্রেমের পূজা, আর দ্বিতীয় খণ্ডে বিরহ ও আত্মশুদ্ধির পথচলা—এই বৈপরীত্য কীভাবে একসূত্রে বাঁধলেন?
দুর্জয়: এই যে বৈপরীত্য যা আপনার প্রশ্নে স্পষ্ট তা কি অস্বীকার করার সুযোগ আছে? জীবনে আজ যা পূজনীয়, কাম্য, আরাধ্য সময়ের পরিক্রমায় প্রতিধ্বনিত হয়ে তা হয়ে ওঠে নির্মম বাস্তবতা - আর বাস্তবতা মানেই কারো নির্মম চলে যাওয়া, মুছে অতীত ছায়া। আর সেখানেই জন্ম নেয় প্রশ্ন—অক্ষয় নাকি অবক্ষয়? আমি অবক্ষয়কে সৃষ্টিশীলতার শক্তিতে রূপান্তর করে হেঁটেছি আত্মশুদ্ধির পথে যেখানে প্রেমের শুদ্ধরূপ হচ্ছে আত্মশুদ্ধি। এই উপলব্ধির পথ ধরেই আমি সাজিয়েছি দেবীসমগ্র।
প্রশ্ন: আপনি বলেছেন, এটি ‘প্রেম, পতন ও পুনর্জন্মের মহাকাব্যিক মানচিত্র’। ‘মহাকাব্যিকতা’ বলতে কী বোঝাচ্ছেন?
দুর্জয়: আমি ‘দুর্জয়’ এই সরল স্বীকারোক্তিই হচ্ছে ব্যক্তি। কারো প্রতি আমার অনুভব, অবভাসিক সৌন্দর্য ব্যক্তিগত হতেই পারে। কিন্তু প্রেমকে শুধু ব্যক্তিগত অনুভূতি বা রোমান্টিক আবেগ হিসেবে দেখতে চাইনি। প্রেম এখানে ব্যক্তিগত অনুভূতির সীমা ছাড়িয়ে এক দীর্ঘ যাত্রা—উত্থান-পতন, সংগ্রাম, ভাঙন, পুনর্জন্মের আখ্যান। যেমন মহাকাব্যের নায়ক বিপদ পেরিয়ে নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে, তেমনি এই প্রেমও ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন করে ওঠে দাঁড়ায়। এ কারণেই একে আমি মহাকাব্যিক বলেছি।
প্রশ্ন: দ্রোহ, আত্মোপলব্ধি ও আত্মশুদ্ধির ধারণা কি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এসেছে?
দুর্জয়: ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছাড়া টেকসই দর্শন গড়ে ওঠে না। এক সময় আমি মোহাবিষ্ট হয়েছিলাম এক আলোকরশ্মির সৌকর্যে। সেই অভিজ্ঞতাই দর্শনে পরিণত হয়েছে—যেখানে ব্যক্তিগত অনুভব ও বাস্তবতা এক বিন্দুতে মিলেছে।
প্রশ্ন: তরুণ পাঠকদের কাছে এই কাব্য কতটা সহজবোধ্য হবে বলে মনে করেন?
দুর্জয়: গ্রহণযোগ্যতা পাঠকের ওপরই ছেড়ে দিই। তবে দেবীসমগ্র একদিকে কবিতার ছন্দে প্রেমকে সামনে আনে, অন্যদিকে গীতিনাট্যের আবহে উপন্যাসের সুর ছুঁয়ে যায়। পাঠক একবার ঢুকতে পারলে মোহিত না হয়ে পারবেন না। পড়ার আহ্বান থাকবে।
প্রশ্ন: শিক্ষকতা ও কবিতা—দুই জগতকে কীভাবে সমন্বয় করেন?
দুর্জয়: শিক্ষকতা, শ্রেণিকক্ষ, বেঞ্চ আর একঝাঁক উৎসুক তারুণ্য আমি ভীষণ উপভোগ করি এখন। কোলাহলের ঢেউ ছাপিয়ে যখন তন্ময় নীরবতায় আমার বক্তব্যকে তারুণ্য প্রাণভরে উপভোগ করে - এর চেয়ে সুন্দর, মিহি, কোমল আর সজীব কি হতে পারে বলুন! আর কবিতা—সেটি আমি নিজেই। আমি প্রায়ই বলে থাকি, যদি আমার হৃদয় দেখার সাধ জাগে, তবে পড় আমার কবিতা আর গল্প— সেখানেই আমি অনাবৃত, নিঃস্বার্থ, নিঃসঙ্গ, কিন্তু সম্পূর্ণ।
প্রশ্ন: আপনার লেখালেখির শুরু কবে এবং কারা আপনাকে প্রভাবিত করেছেন?
দুর্জয়: সেই ছেলেবেলা থেকে। গ্রামের মেঠোপথ, নদীর পাড় আর বিস্তীর্ণ ধানের মাঠ। বিকেলে সবাই যখন ক্রিকেট ফুটবল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠতো, আমি তখন একটি কলম আর খাতা বুকপকেটে লুকিয়ে চলে যেতাম নদীর গাঘেঁষে ফসলের আইল ধরে। কত কথা, কত স্বপ্ন যে একা একা দেখেছি…। সেই থেকে শুরু, আজও শুরুটা যেন সেই শুরুতেই আটকে আছে। সৃষ্টিশীল প্রতিটি মানুষই আমাকে প্রভাবিত করে। কখনো নজরুল, কখনো কবিগুরু আবার কখনো সদ্য হাতেখড়ি হওয়া তরুণ কোনো লেখক।
প্রশ্ন: ‘দেবীসমগ্র’ প্রকাশের পর আপনার পরবর্তী লেখালেখির পরিকল্পনা কী?
দুর্জয়: “নামটি তুমি লিখে নিও” নামে একটি নতুন গ্রন্থ প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। এতে থাকবে অণুগল্প, ছোটগল্প ও ঔপন্যাসিকা। পাশাপাশি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ওপর একটি মৌলিক গ্রন্থ রচনার চিন্তাও করছি।
প্রশ্ন: আপনার কবিতার পাঠকদের জন্য বার্তা কী?
দুর্জয়: কবিতা সুন্দর, কবিতা পবিত্র, কবিতা কথা বলে। আমার কবিতাগুলোও খুব সুন্দর মোহনীয় মায়ায় কথা বলে। পাঠককে শুধু কবিতার ভাষাটা বুঝতে হবে। নীল টিক চিহ্ন নয়, আমি পাঠকদের জন্য আমার কবিতাগুলো উপহার হিসেবে রেখে যেতে চাই।
প্রশ্ন: শেষমেশ—আপনার নিজের সংজ্ঞায় কবিতা কী?
দুর্জয়: কবিতা শব্দের সাথে হৃদয়ের আর হৃদয়ের সাথে আত্মার মেলবন্ধন নির্মাণ করে। কবিতা তাই যা শিক্ষার্থীর জন্য এটি আবশ্য পাঠ, রাজনীতিকের জন্য দীক্ষা, গবেষকের জন্য চিন্তার খোরাক, প্রেমিকের জন্য প্রেমিকা—প্রেমের জন্য অলিখিত চুক্তি, কবিতা মানেই শর্তহীন নিঃস্বার্থ মুক্তি।





































